শ্যামনগর ইউনিয়ন নদ-নদীর বর্ণনাঃ
শ্যামনগর ইউনিয়ন পূর্বদিকেঃ কপোতাক্ষও খোলপেটুয়া নদী। শ্যামনগর ইউনিয়ন পশ্চিমদিকেঃ রায়মঙ্গল নদী। গঙ্গার দুটি প্রধান শাখা পদ্মাও ভাগিরথীর শেষ প্রান্ত কপোতাক্ষ ও ইছামতি কালিন্দীর মধ্যভাগের গড়ে ওঠা জনপদের নাম শ্যামনগর। শ্যামনগর ইউনিয়ন মধ্যে প্রবাহিত, মৃত বা প্রায় মৃত নদীগুলোর মধ্যে কালিন্দী, আদি যমুনা, ইছামতি, চুনার, মালঞ্চ, কদমতলা, আইবুড়ি, মাদার, খোলপেটুয়া কপোতাক্ষ, মিরগাঙ প্রভৃতি।
যমুনা ও ইছামতি-বর্তমানে মৃত পূর্বে প্রবল বেগবতি যমুনা ইতিহাসের শুভেচ্ছাধন্য- ধন্য করেছে শ্যামনগরের মাটি। মা, মাটি, মানুষ এ তিনে ধন্য শ্যামনগর ইতিহাসের বরপূত্র সে। যমুনা, প্রত্যাপাদিত্য যশোহর এ তিনে ধন্য শ্যামনগর আজ এখানে বিরানভূমি-রাম, অযোদ্ধা-কোনটিই নেই। নেই প্রতাপাদিত্য নেই যমুনা, নেই যশোহর আছে শ্যামনগর। এ যমুনা সেই যমুনা মহাভারতের মাটির স্পর্শ যেখানে। যে যমুনার তীরে দিল্লী-আগ্রায়, মথুরা প্রয়াগে, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান, মোঘল ইংরাজ শত শত রাজ রাজেশ্বর সমগ্র ভারতের রাজদন্ড পরিচালনা করিতেন। সকলেই জানেন যমুনা ও সরস্বতী বিভিন্ন পথে আসিয়া প্রয়াগ বা এলাহাবাদের নিম্নে গঙ্গার সাথে মিশিয়াছে। এই যুক্ত প্রবাহ বঙ্গভূমিতে ভাগিরথী নামে সপ্তগ্রাম পর্যন্ত আসিয়া স্বরস্বতী দক্ষিনে ও যমুনা নামে বামে বিমুক্ত হইয়া পড়িয়াছে। এই ত্রিবেনী হইতে যমুনা কিছু দূর পর্যন্ত চবিবশ পরগনা ও নদীয়া এবং পরে চবিবশ পরগনা ও যশোরের সীমানা নির্দেশ করিয়া পূর্ব-দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হইয়া অনেকস্থান ঘুরিয়া দক্ষিণ দিকে পদ্মা নামক শাখা বিস্তার করিয়া চারঘাটের কাছে ইছামতির সহিত মিলিত হইয়াছে। ইছামতি সোজা দক্ষিনে অগ্রসর হইয়া বসুরহাট (বসিরহাট), টাকী, শ্রীপুর, দেবহট্ট, বসন্তপুর ও কালীগঞ্জ দিয়া যশোরেশ্বরী মন্দিরের নিকটে যমুনা ও ইছামতি পৃথক হইয়া ডানদিকে মামুদো নদী হইয়া সমুদ্রে পড়িয়াছে এবং ইছামতি বামভাগে কদমতলী ও মালঞ্চ প্রভৃতি নাম পরিবর্তন করি সাগরে মিশিয়াছে। (এখনে যমুনা ও ইছামতির প্রবাহের শ্যামনগর অবস্থিতি দেখিলাম)
চারাঘাট হতে যমুনা নাম বিলুপ্ত হয়ে ইছামতি হয়। বসন্তপুর হতে ইছামতির পূর্বদিকে আবার যমুনা প্রবাহিত হয়। যমুনার ন্যায় স্রোতস্বিনী নদী সে যুগে আর ছিল কিনা সন্দেহ। কালিন্দীর স্রোত প্রবল হবার পর যমুনার যৌবন ফুরিয়ে যায়। উহাতে আর জোয়ার আসে নাই। ১২৭৪ সালের এক ভীষন ঝটিকায়(টরর্ন্ডো) ১২ ফুপ পানি বৃদ্ধি পায়। সেই সময় হতে যমুনার স্রোত একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। বালিজমে যমুনার গতি শান্তভাব ধারন করে। ওদিকে কালিন্দীর জোয়ার যমুনায় প্রবেশ করে যমুনাকে দোটানা করে দেয়এবং অল্প দিনের মধ্যে বিশালকায় যমুনা ভরাট হয়ে যায়। যমুনা নদী এখন শুষ্কপ্রায়। একটি খালের মত্সুক্ষ রেখা এখনো যমুনার চিহ্ন রেখে গেছে। এই নদীর মধ্যে এখন সুন্দর ফসল ফলে। যে নদীর তীরে রাজা প্রতাপাদিত্যের সাথে মোঘল সেনাপতি মানসিংহের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এবং যে নদীমে মুঘল ও প্রতাপাদিত্যের রণসম্ভার বহন করে অসংখ্য রণতরী যাতায়াত করত তা এখন মৃত। রোথনপুরের ত্রিমোহনা,জাহাজঘাটার চাকচিক্য মুকুন্দপুর ও মহৎপুরের গড় রাজধানীর ধুমধাম,ধূমঘাটেরদূর্গ সবই ধূলির সাথে বিলীন হয়েছে।
কপোতাক্ষ নদীঃসুন্দরবন প্রদেশের আর একটি বিখ্যাত নদীর নাম কপোতাক্ষ(Eye of apegion)। ভৈরব নদী হতে উৎপত্তি হয়ে কপোতাক্ষ ক্ষদ্রাকারে চৌগাছা,ঝিকরগাছা,চাকলা,ত্রিমোহনী,সাগরদাঁড়ি,তালা, কপিলমুনি রাড়ুলীু,চাঁদখালী, বড়দল, আমাদি,বেদকাশি প্রভৃতি প্রসিদ্ধ স্থান সমূহের পার্শ্ব দিয়ে সুন্দরবনের মধ্যে খোলপেটুয়ার সঙ্গে মিশেছে। কপোতাক্ষ-পদ্মার শাখা কপোতাক্ষ যশোর থেকে কেশবপুর মাইকেল মধুসুদন দত্তের সাগরদাঁড়ী হয়ে রাড়ুলী আচার্যপ্রফুল্ল রায়ের বাড়ি ডাইনে ফেলে গাবুরা (শ্যামনগর) ইউনিয়নের চাঁদনীমুখার পাশ দিয়ে আড়পাঙ্গাশিয়া নাম নিয়ে সুন্দরবনের ভিতর মালঞ্চের সাথে মিলে সাগরে পড়েছে।
এ সঙ্গমস্থলেই কপোতাক্ষ ফরেস্ট অফিস। খোলপেটুয়া ও কপোতাক্ষের স্রোত প্রবল হয়ে আড়পাঙ্গাশিয়া নাম ধারন করেছে। বঙ্গোপসাগর হতে দশ-বার মাইল উত্তরে আড়পাঙ্গাশিয়া নদী উত্তর-পশ্চিম দিক হতে আগত মালঞ্চ নদীর সাথে মিশে সমুদ্র পর্যন্ত মালঞ্চ নাম ধারন করেছে। এ নদীর মোহনায় স্রোত ভয়ংকর। ১৭৬৬ খ্রীস্টাব্দে বৃটিশ জাহাজ ‘‘ ফালমাথ’’ এখানে নিমজ্জিত হয়। মালঞ্চ ও রায়মঙ্গল এর দক্ষিণ দিকে বিখ্যাত অতলষ্পর্শ বা অতলতল অবস্থিত।
কপোতাক্ষ হতে হরিহর নদী এসে ভদ্রে মিশেছে। ত্রিমোহনী ও মির্জানগর ভদ্রের তীরে মূঘল ফৌজদারের রাজধানী ছিল।
খোলপেটুয়া নদীঃকপোতাক্ষের স্রোত বৃদ্ধি প্রাপ্ত হওয়য় ভৈরবের স্রোত হ্রাস পেয়ে এটি একেবারে মজে যায়। যশোর জেলার সর্বাঙ্গিন উন্নতির অন্তরায় হয়ে পড়ে এ মরা ভৈরব। বর্তমানে এককালীন প্রলয়ঙ্করী ভৈরবের উপর দিয়ে বহু স্থানে পদব্রজে লোক যাতায়াত করে। বসুন্দিয়ার নিম্নে আফত্মার খালের দ্বারা চিত্রার জল ভৈরবে পড়ত বলে সে স্থান হতে নদী এখনো নামে মাত্র জীবিত আছে। আলাইপুর হতে বাগেরহাট পর্যন্ত একরূপ মজে গেছে। কয়েকবার সংস্কার করার পরও পূর্বতন অব্স্থায় ফিরে পাবার কোন আশা নেই। তবে এ পথে এখনো নৌকা চলাচল অব্যাহত আছে। কপোতাক্ষের মত বেতনা বা বেত্রাবতী ভৈরবের আর একটি শাখা। সোনাই নদী ইছামতি হতে উৎপত্তি হয়ে সাতক্ষীরার বল্লী বিলে পতিত হয়েছে। বেতনা মহেশপুরের সন্নিকটে ভৈরব হতে বের হয়ে নাভারন,বাঘাছড়া ও কলারোয়া হয়ে খুলনার সীমানায় এসে বুধহাটায় গাঙ নাম ধারন করতঃ সুন্দরবনের সন্নিকটে খোপেটুয়ায় মিশেছে। গুতিয়াখালী ও উজিরপুরের কাটাখালের সঙ্গমস্থল হতে গলঘেসিয়া নদী কল্যাণপুর ও শ্রীউলা গ্রামের নিকট দিয়ে খোপেটুয়ায় পড়েছে। উজিরপুর ও কাটাখাল এবং গুতিয়াখালী একসময় কলকাতার পণ্য দ্রব্য নৌকাযোগে আসাম ও পূর্ববঙ্গে বহন করত। গলঘেসিয়া সুন্দরবন যাতায়াতের একটি বিশিষ্ট নদীপথ। খোলপেটুয়া-ভেরবের শাখা বেতনা নদী যশোরের নাভারন বাগাঁচড়া হয়ে সাতক্ষীরা শহরে প্রবেশ করেছে। সামনে অগ্রসর হয়ে বুধহাটার গাঙ নামধারণ করে আশাশুনি কালিগঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রতাপনগরের কাছ থেকে শ্যামনগর প্রবেশ করেছে। শ্যামনগরের আটুলিয়া ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে খোলপেটুয়া নাম নিয়ে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে সাগরে যুক্ত। (পৃঃ-৪, সুন্দরবনাঞ্চলঃ মাটি ও মানুষ)
আসলে নদীমাতৃক বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চলে নদীর প্রাবল্য বেশী। শ্যামনগরকে তাই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপের সমারোহে সৃষ্ট উপজেলা বলা চলে। নদী দ্বারা পৃথক করা ১২টি ইউনিয়নের শ্যামনগর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর বিধৌত সুন্দরবন, পূর্বে কপোতাক্ষ, পশ্চিমে কালিন্দী আর মধ্যভাগে যমুনা চুনার, খোলপেটুয়া, আইবুড়ি, কদমতলা, মাদার প্রভৃতি নদী ও খাল বেষ্টিত শ্যামনগর তাই ইতিহাস ধন্য।
রায়মঙ্গলঃশ্যামনগর ও সুন্দরবনের পশ্চিমদিকের বৃহত্তম নদী রায়মঙ্গল। এ নদী ও পদ্মার সাথে সংযুক্ত। মাথাভাঙ্গা নদী ভৈরব ছেড়ে দক্ষিণদিকে কৃষ্ঞগঞ্জের নিকট চুনী নাম ধানরন করে উহার এক শাখা পূর্বাভিমুখে বহির্গত হয়েছে। এ নদীর নাম ইছামতি। ইছামতি বনগ্রাম রেলস্টেশনের পূর্বদিক দিয়ে গোবরডাঙ্গার দক্ষিণে বিখ্যাত যমুনা নদীর সাথে মিশেছে। ভাগীরথী হতে বাঘেরখাল নামক স্থান যমুনার উৎপত্তিস্থল। যমুনাক্রমে চৌবেড়িয়া ও গোবরডাঙ্গা ঘুরে অবশেষে চারাঘাটের নিকট ইছামতির সাথে মিলিত হয়েছে। ইছামতি সোজা দক্ষিণমুখী হয়ে বসিরহাট,টাকী, দেবহাটা,শ্রীপুর, ও কালিগঞ্জ হয়ে ঐতিহাসিক যশোর বা ঈশ্বরীপুরে মিশেছে। এখানেই রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রসিদ্ধ যশোর রাজ্যের রাজধানী ছিল। বসন্তপুর হতে ইছামতি কালিন্দী নাম গ্রহণ করেছে। পূর্ব এটি একটি খালের মত ছিল। পরে কালিন্দী নদীর প্রবাহ বৃদ্ধি পেতে থাকে সাহেবখালী কাকশিয়ালী খাল খননের পর কালিন্দী বেগবতী হয়ে সুন্দরকনের মধ্যে প্রবেশ করে রায়মঙ্গল নাম ধারন করে। এ নদী বর্তমান বাংলাদেশুভারতের সীমা নির্দেশ করে। দেশ বিভাগের পর রায়মঙ্গলের তীরে সীমান্ত পুলিশ ও শুল্ক বিভাগের অফিস স্থাপিত হয়েছে। রায়মঙ্গল ক্রমাগত ভীমমূর্তি ধারন করতঃ বঙোগাপসাগরে পতিত হয়েছে। রায়মঙ্গল নদী ও মাদারবাড়ীর চরের উত্তর দিক হতে নদী পশ্চিম-দক্ষিণমুখী হয়ে হরিণভাঙ্গা নাম ধারনকরতঃ সাগরগর্ভে বিলীন হয়েছে।মাদারবাড়ীর চর প্রথমে ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল পরে উহা বাংলাদেশভুক্ত হয়েছে।
কালিন্দী-বসন্তপুরের উত্তরাংশে যমুনা-ইছামতি হইতে কালিন্দী নামক একটি ক্ষুদ্র শাখা দক্ষিণ দিকে গিয়াছিল। প্রতাপাদিত্যের সময় ইহা প্রবল ছিল না খালের মত ছিল। ১৮১৬ খৃঃ ইহা হইতে একটি খাল কাটিয়া বড় কলাগাছিয়া নদীর সহিত মিশাইয়া দেওয়া হয়। ইহাকে সাহেবখালি বলে ইছামতির ভাটার জল এই পথে প্রবাহিত হওয়ায় কালিন্দীক্রমে বড় হইয়া উঠিল। ইহাই ভারতের সাথে শ্যামনগর উপজেলার সীমানা নদী। শ্যামনগর নূরনগর ও কৈখালীর পশ্চিম সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রায়মঙ্গলে মিশে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। ঈষৎ সংকলিত-যশোহর খুলনার ইতিহাস-সতীশ মিত্র।
বর্ণিত নদী সমূহ দিবারাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রতিবারে ৬ ঘন্টা করে ২ বার জোয়ার ও ২ বার ভাটা হয়। ভাটার সময় বনাঞ্চলের পানি সমূদ্রে পতিতহয় এবং জোয়ারের সময় সমূদ্রের পানিতে নদী ফেঁপে ওঠে।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS